Dhaka Mail News Details

back

কেউ কেউ জ্ঞানের আলোয় নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। কেউবা অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান ছড়িয়ে দেন। তাদের জ্ঞান আর উদ্ভাবনী চিন্তা বদলে দেয় অন্যদের ভাবনা। পরিবর্তন আসে সমাজে। বিজ্ঞানের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন আরিফুল হাসান অপু। শিশু, কিশোর তরুণদের তিনি দিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানের বার্তা। কেমন ছিল এই উদ্ভাবক উদ্যোক্তার পথচলা? কী কী কাজে সম্পৃক্ত আছেন তিনি? ঢাকা মেইলকে শুনিয়েছেন তার গল্প।

অপুর জন্ম ফেনীতে। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়-অর্থাৎ স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনার পুরো পাঠ সম্পন্ন করেন সেখানেই। এরপর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ১৯৯৭ সালে পাড়ি জমান ঢাকায়। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে এমবিএ করেন। একইসঙ্গে তিন বছরের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা কোর্সও করেন। জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে দেশের গণ্ডি পার করে বিদেশেও যান অপু। আমেরিকা থেকে স্কিল ডেভেলপের জন্য আরও কিছু কোর্স করেন।

বিজ্ঞানের প্রতি অপুর আগ্রহ বেশ ছোটবেলা থেকেই। স্কুলজীবনে বিজ্ঞানমেলায় অংশ নেওয়ার পর এই বিষয়ের প্রতি আলাদা ভালোবাসা অনুভব করেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন বিজ্ঞানমেলায় অংশ নেন। তৈরি করেন মাটির তৈরি রেগুলেটর। সেই প্রজেক্টের জন্য পান পুরস্কারও। এতে আগ্রহ বেড়ে যায় দ্বিগুণ।

এরপর থেকে স্কুল কলেজে প্রতিবছরই বিজ্ঞানমেলায় অংশ নিতেন তিনি। বিজ্ঞান প্রযুক্তি জাদুঘরের আয়োজনে করা জাতীয় বিজ্ঞানমেলায় জেলা পর্যায়ে ফেনী থেকে টানা বারের চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়েও বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ভালো ফল করেন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রায় ৫০টি বিজ্ঞান আইটি মেলায় অংশ নেন। এর ৩২টি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। বাকিগুলোতেও দ্বিতীয় বা তৃতীয় হন। কিছু ক্ষেত্রে কোনো পুরস্কার মেলেনি এমনও ছিল।

অপু বলেন, ‘মূলত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নিতেই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সেই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

দীর্ঘ কর্মজীবনে অসংখ্য উদ্যোগ আর উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করেন অপু। এর মধ্যে কিছু কিছু বেশ জনপ্রিয় হয়। দেশজুড়ে সাড়াও ফেলে। তার প্রথম সফল উদ্ভাবন ছিলটেন ইন ওয়ান সার্কিট সারা বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল এটি। একটি সার্কিট দিয়ে মাউন্টেন রোড সিকিউরিটি, বার্ড গ্লাস অ্যালার্ম, ফায়ার কন্ট্রোলিং সিস্টেমের মতো ১০ ধরনের কাজ করা যেত।

এরপর যে উদ্ভাবন নিয়ে অনেক আলোচনা হয় সেটি হলো অটোমেটিক টিউবওয়েল। ২০০২ সালে এটি তৈরি করেন অপু। কলের নিচে হাত নিয়ে গেলে পানি পড়বে। হাত সরিয়ে ফেললে পানি পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। এটি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হয়েছিল। উদ্ভাবনটির জন্য অনেক পুরস্কারও জেতেন তিনি।

সেন্সরের মাধ্যমে পানি পড়া এবং বন্ধ করা নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তিটি বিষয়ে অপু বলেন, ‘বর্তমানে অনেক জায়গায় অটোমেটিক কল দেখা গেলেও ২০ বছর আগে তা ছিল অপরিচিত। দেশীয় প্রযুক্তিতে মাত্র ২৫০ টাকা খরচে এই কল বানানো হয়। তবে পরবর্তীতে কাজটি নিয়ে বেশিদূর আগানো হয়নি।

তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক সেবা প্রতিষ্ঠান -সফটের প্রধান নির্বাহী অপু। ইনোভেশন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এটি পুরোদস্তুর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। বেশ কয়েকটি ইনোভেশন নিয়ে এখানে কাজ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে জনপ্রিয় সেবাকনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট সলিউশন একটি কনফারেন্স বা ফেয়ারের পেপারলেস সিস্টেম তৈরি করে দেওয়া হয় এই সেবার মাধ্যমে।

এই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জনপ্রিয় ইনোভেশন হলোইলেকট্রনিক জার্নাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম জার্নাল এবং পাবলিকেশনের সব ধরনের সেবার ডিজিটাল রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে এর সূচনা। ম্যানুয়ালের তুলনায় খরচ কমায় এবং সহজে মানুষের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হওয়ায় এর প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।

বর্তমানে ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন নিয়ে কাজ করছে -সফট। ডাক্তার যেন রোগীকে দ্রুত সেবা দিতে পারেন, কম সময়ে যেন প্রেসক্রিপশন দিতে পারেন সেজন্য এআই নির্ভর প্রেসক্রিপশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি নিয়ে গবেষণা চলছে।

জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রায় ৪৫টি বিজ্ঞান তথ্যপ্রযুক্তি মেলার নির্দেশক বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন অপু। ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর পরিচালক। নাসা আয়োজিত আন্তর্জাতিক স্পেস অ্যাপ চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ পর্বের তিন বার কনভেনর ছিলেন এই উদ্ভাবক।

বর্তমানে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের স্মল স্যাটেলাইট বা ন্যানো স্যাটেলাইটের (ক্যান স্যাট) রকেট টেকনেলোজির ওপর একটি প্রজেক্টে মেন্টর হিসেবে আছেন। একটি টিমকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। এছাড়াও অসংখ্য প্রজেক্টে মেন্টর হিসেবে যুক্ত আছেন।

একটি উদ্ভাবন মানে নতুন কিছু সৃষ্টি। আর এই পথ সাধারণত মসৃণ হয় না। প্রতিটি উদ্যোক্তা বা উদ্ভাবকই কাজ শুরুর প্রথম পর্যায়ে বাধার সম্মুখীন হন। তিনিও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। এই যেমন একটি উদ্যোগ শুরু করার পর দেখলেন তিনি যেমনভাবে ভেবেছিলেন সেভাবে আর আগানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ উদ্যোগটির জন্য যেসব তথ্যের প্রয়োজন ছিল অনলাইনে তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে মাঝপথে উদ্যোগটি থামিয়ে দিতে হয়।

এই উদ্ভাবক উদ্যোক্তা মনে করেন, কোনো উদ্যোগ শুরু করার পূর্বেই তা নিয়ে পূর্ববর্তী ইতিহাস, কারা কারা এই সংশ্লিষ্ট কাজ করেছে, তাদের অর্জন বা ব্যর্থতা সম্পর্কে জেনে নিলে পরবর্তী পথ চলা সহজ হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র আয়োজিত একটি বার্ষিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতানাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ এখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহাকাশ প্রকৌশলীদের তৈরি মহাকাশ অনুসন্ধানের যুগান্তকারী ধারণার প্রতিফলন ঘটে। বাংলাদেশ থেকে বিগত আট বছর ধরে এই প্রতিযোগিতায় মেধাবী প্রতিযোগী পাঠানো হয়। বেসিসের নেতৃত্বে করা এই আয়োজনের শুরু থেকে তিন বছর আহ্বায়ক ছিলেন অপু। বর্তমানে তিনি অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করছেন।

বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের প্রেসিডেন্ট আরিফুল হাসান অপু। কোন ভাবনা থেকে এই উদ্যোগের শুরু? জানতে চাওয়া হলে অপু বলেন, ‘আমি মনে করি, যেকোনো দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের ইনোভেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশেপাশে যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো সমাধানে আমরাই নতুন একটি ইনোভেশনের চিন্তা করতে পারি। আমাদের দেশের ইয়াং ট্যালেন্ট যারা আছে তাদের যদি ঠিকমতো গাইড করা যায় তাহলে তারা ভালো করবে। এই ভাবনা থেকে ২০১৫ সালের আগস্টের দিকে যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি।

সারাদেশের মধ্যে উদ্ভাবনী চর্চা ছড়িয়ে দেওয়া এবং যুব সমাজের যে উদ্ভাবনী চিন্তা আছে তা বাস্তবায়নে সাহায্য করা এই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। বর্তমানে পুরো বাংলাদেশে বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের প্রায় ৭০ হাজার সদস্য আছে। প্রতিটি জেলায় রয়েছে অফিসিয়াল কমিটি। ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত আছে সংগঠনটির সঙ্গে।

এই পর্যন্ত ২৫০ এর বেশি সেমিনার, ওয়ার্কশপ, সামিট, কনফারেন্স করেছে বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম। লেটেস্ট টেকনোলোজি, সামনের দিনগুলোতে ইনফরমেশন টেকনোলোজি বা অন্যান্য টেকনোলজি কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে এসব সেমিনার বা ওয়ার্কশপে আলোচনা করা হয়। এছাড়া ক্যারিয়ার, বোবটিক, স্পেস, রকেট ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের প্রথম আইওটি কনফারেন্সের আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম। গত তিনবছর ইনোভেশন সামিট করছে সংগঠনটি। এসব আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

অপু মনে করেন, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী। কারণ সায়েন্স, ম্যাথ, টেকনোলোজি সবই এখন আমাদের ব্যক্তিজীবনের অংশ হয়ে গেছে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘২০১৮, ১৯ পরপর দুই বছর প্রায় ১৬০০ তরুণকে নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল স্পেস ইনোভেশন সামিট। প্রচুর সাড়া মিলেছিল। আসন সংখ্যা শেষ হলেও অনেকে যুক্ত হতে চাচ্ছিল। অর্থাৎ তাদের আগ্রহ ছিল। আবার, ২০১৯ সালের অক্টোবরে ৮০০ শিশুকে নিয়ে আয়োজন করা হয় স্পেস ইনোভেশন ক্যাম্প। দিনের সেই আয়োজনেও প্রচুর সাড়া মিলেছিল। এখনও নানা ধরনের আয়োজন চলছে।

তবে বিজ্ঞানের যে মজার মজার ব্যাপারগুলো আছে এবং বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে কীভাবে নিজেকে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে- সেই ব্যাপারগুলো যদি তরুণদের ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে শেখানো বা জানানো যায় তাহলে তারা বিজ্ঞানের প্রতি আরও আকৃষ্ট হবে। কারণ বিজ্ঞান কেবল পুঁথিগত বিদ্যা নয়। ব্যবহারিক শিক্ষায় শেখার জিনিস। তা নিশ্চিত করলেই তরুণদের আগ্রহ বাড়বে।’-যোগ করেন তিনি।

অনেক কাজে যুক্ত আছেন। এত কাজের ভিড়ে কখনো কী হতাশ হয়েছেন? হলে কীভাবে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন? জানতে চাওয়া হলে অপু বলেন, ‘হতাশা আসে। তবে তা ঝেড়ে ফেলি। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করি। যতদিন বেঁচে আছি, তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজ করে যাব।

দেশের তরুণ প্রজন্ম নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন অপু। ভবিষ্যতেও তা করতে চান। স্পেস ইনোভেশন ক্যাম্প নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এখানে শিশু-কিশোররা মহাকাশ বিজ্ঞান, রোবটিক্স, এভিয়েশন টেকনোলোজি এসব নিয়ে কাজ করে। এদেশের শিক্ষার্থীরাই একদিন স্যাটেলাইট তৈরি করবে- এমন স্বপ্ন দেখেন তিনি