bbarta24.net News Details

back

আমাদের শিশু-কিশোররা অনেক মেধাবী। তারা এখন রোবট বানাচ্ছে, রকেট বানাচ্ছে, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের নতুন নতুন উদ্ভাবন করছে। সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যখন হয়তো আমরা নিজেরাই স্যাটেলাইট-রকেট উৎক্ষেপণ করতে পারব। আর সেটা পারবে আমাদের পরের প্রজন্ম। তখনকার পৃথিবী আর এখনকার মত থাকবে না। তখন পুরো পৃথিবী হয়ে যাবে টেকনোলজি বেইজড।

বিবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপে বলেন বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম ও নাসা সলভ বিডি-এর প্রতিষ্ঠাতা আরিফুল হাসান অপু।

দেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মহাকাশবিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষার আগ্রহ তৈরি করতে, মহাকাশ গবেষণা যন্ত্রপাতি নিয়ে রকেট টেকনোলজির দক্ষতা বৃদ্ধি, গ্রাউন্ড স্টেশনের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে কাজ করছেন তিনি। ইতোমধ্যে বেশ এগিয়েছেনও। স্বপ্ন দেখেন সরকারের সহযোগতিায় দেশে স্পেস ল্যাব ও স্পেস সিটি বানানোর।

তার মতে, আজকের শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ অ্যাস্ট্রনট বা সায়েন্টিস্ট। তাই তিনি দেশের ভবিষ্যৎ অ্যাস্ট্রনট ও সায়েন্টিস্টদের খুঁজে বের করতে প্রতি তিন মাস পর পর স্পেস ইনোভেশন ক্যাম্প ও ওয়ার্কশপ করছেন। ওয়ার্কশপে ক্ষুদে মহাকাশবিজ্ঞানপ্রেমীদের হাতে কলমে রকেট বানানো শেখানোসহ মহাকাশবিজ্ঞান বিষয়ে নানান ধরনের শিক্ষা দিচ্ছেন।

এই কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে গত জুলাই মাসে ইউএস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টার থেকে রকেট টেকনোলজির উপরে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন এই বিজ্ঞানপ্রেমী।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারস্থ বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের প্রধান কার্যালয়ে সম্প্রতি বিবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপে উঠে এসেছে আরিফুল হাসান অপুর মহাকাশ বিজ্ঞানকে নিয়ে তার কার্যক্রম ও নানান পরিকল্পনার কথা।

বিবার্তা : আপনি জুলাই মাসে ইউএস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টারের আমন্ত্রণে ‘অ্যাস্ট্রনট ট্রেইনিং’ করে এসেছেন। ওখানকার অভিজ্ঞতাটা জানতে চাই।

আরিফুল হাসান অপু :আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, ইউএস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টার ও নাসার সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশী হিসেবে কোনো অ্যাস্ট্রনট ট্রেইনিংয়ে অংশগ্রহণ করেছি। এই ট্রেইনিংটা ছিল সাতদিনের। মূল ট্রেনিংটা ছিল এক মাসের। আর ফিজিক্যাল ট্রেনিংটা ছিল ৭ দিনের। সারা পৃথিবী থেকে ইয়ং সায়েন্টিস্টরা ইউএস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টারে আমার সাথে এই ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। সেখানে রকেট টেকনোলজি নিয়ে বেসিক এমন কিছু শিখেছি যেগুলো আমার জন্য অনেক উপকার হয়েছে। অনেক নতুন নতুন বিষয় শিখেছি। ট্রেনিংয়ে আমি রকেট মুভিং, রকেট মেকিং, রকেট কীভাবে কাজ করে, রকেট ফাস্ট মুভিং, কন্ট্রোলিং, রকেটের ফুয়েলের ব্যবহার বিধি এসব বিষয়ে জেনেছি।

এই ট্রেনিংয়ের সুবাদে নাসা, এমআইটি ল্যাব প্রত্যেকটা জায়গায় আমার ভিজিট করার সুযোগ হয়েছে। এমআইটি জিরো রোবটিকস ল্যাব এবং এমআইটি অ্যারোস্পেস ল্যাব দুটো ঘুরে দেখার পাশাপাশি তাদের ইকুইপমেন্টে আমি নিজে বসে কাজ করেছি। তাদের যে রোবটটা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে আছে সেটা আমি সিমুলেট করে দেখেছি কীভাবে কাজ করে। রকেটের উড্ডয়ন থেকে শুরু করে চাঁদের পিঠে ল্যান্ডারের নামা পর্যন্ত পুরো চন্দ্রাভিযানের একটা ‘রিয়েলিস্টিক সিমুলেশন’ করার অভিজ্ঞতাও হয়েছে আমার। এই মিশনে একেকজন একেক ভূমিকায় ছিলেন; আমি ছিলাম ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। মুন ওয়াকিং ছাড়াও এই কর্মশালায় আমার অভিজ্ঞতা করেছি মহাকর্ষীয় বল (জি-ফোর্স) আর শূন্য অভিকর্ষ (জিরো গ্র্যাভিটি) অনুভব।

বিবার্তা : এবারের নাসা ভিজিটে আপনার অনেক অ্যাস্ট্রনট ও স্পেস সায়েন্টিস্টদের সাথে কথা হয়েছে। ভবিষ্যৎ অ্যাস্ট্রনটদের উদ্দেশে তাদের পরামর্শ কী?

আরিফুল হাসান অপু : এই ট্রেনিংয়ে আমার অনেক ইয়ং অ্যাস্ট্রনট ও স্পেস সায়েন্টিস্টদের সাথে আলাপ এবং তাদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। এই বিষয়য়ে অ্যাস্ট্রনট ডন থমাস বলেন, কেউ যদি অ্যাস্ট্রনট হতে চান, তাহলে তাকে অসীম ধৈর্যের অধিকারী ও প্রচুর পরিমাণে পড়াশোনা করতে হবে। বিরামহীনভাবে লেগে থাকতে হবে। যেমন আমি পর পর তিনবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে চতুর্থবারে নাসা স্পেস সেন্টার থেকে অ্যাস্ট্রনট হওয়ার জন্য ডাক পাই। অরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাকে ১০০ ভাগ সময়নিষ্ঠ হতে হবে।

বিবার্তা : দেশের প্রেক্ষাপটে মহাকাশবিজ্ঞান শিক্ষার ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

আরিফুল হাসান অপু : বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মাঝেও রয়েছে মহাকাশবিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইনোভেশন কালচার গড়ে তোলতে ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ ইনোভশন ফোরামের। তখন থেকে শিশু-কিশোর আর তরুণ প্রজন্মের কাছে মহাকাশ বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে কাজ করছে সংগঠনটি। সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক মেধাবী তরুণদের সাথে পরিচয় হয়েছে। তাদের মহাকাশবিজ্ঞান শিক্ষায় ভালভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে বিশ্বের যে কোনো মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় কাজ করার বিপুল সুযোগ রয়েছে। আর মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে দেশের তরুণ প্রজন্মই যে তৈরি হচ্ছে তা নয়; বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রোকৌশলেও গড়ে উঠছে শিশু-কিশোররা। সামনের দিনগুলোতে এই প্রজন্মই রকেট-স্যাটেলাইট বানিয়ে মহাকাশে পাঠাতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

বিবার্তা : তরুণদের মহাকাশবিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করতে আপনারা কী কী করছেন?

আরিফুল হাসান অপু : আমরা চাচ্ছি একটা সায়েন্স ও টেকনোলজি বেইজড সোসাইটি গড়ে তুলতে, যেটা আমাদের পরের প্রজন্ম পাবে। আমাদের মধ্যে টেকনোলজি ও ইনোভেশন যদি না থাকে তাহলে আগামীতে আমরা খুব বেশি দূর আগাতে পারবো না। আগামী যুগটা হবে কিন্তু পুরোটাই টেকনোলজি বেইজড। আজকের যেসব শিশুরা ক্লাস ওয়ান, টুতে পড়াশোনা করছে, আগামী ১০ বছর পরে তারা যেটা পাবে সেটা কিন্তু বর্তমানের মতো আর থাকবে না। আমরা শিশু-কিশোরদেরকে হাতে কলমে যে শিক্ষাগুলো দিচ্ছি সেগুলো তাদের মহাকাশবিজ্ঞান গবেষণা শিক্ষা বিকাশে অনেক সহায়তা করবে।

বিবার্তা : স্পেস সায়েন্স নিয়ে আপনারা বছরব্যাপী সেমিনার করছেন। এর বাইরে বড়দের জন্য কোনো কার্যক্রম করছেন কিনা?

আরিফুল হাসান অপু : দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মহাকাশ গবেষণা যন্ত্রপাতি নিয়ে রকেট টেকনোলজি সম্পর্কে দক্ষতা বাড়াতে আমরা সারাবছর ছোট ছোট ওয়ার্কশপের মাধ্যমে ইনোভেশন ক্যাম্প করছি। এর বাইরে অমারা বড় দুটি সামিট আয়োজন করি। একটা ‘স্পেস ইনোভেশন সামিট’ ও ‘নাসা স্পেস সামিট’। নাসা সল্ভ বাংলাদেশের আয়োজনে ষষ্ঠ থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এই সামিট করা হয়ে থাকে। অমরা ইতোমধ্যে `নাসা স্পেস সল্ভ বাংলাদেশ’ নামে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও গড়ে তুলেছি, যার মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

গত ১৯ জুলাই স্পেস ইনোভেশন সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ১০-১২ অক্টোবরে আবার একটা ক্যাম্প আয়োজন করা হবে। এভাবে প্রতি দিন মাস পর পর এই ক্যাম্প করার পরিকল্পনা রয়েছে। ক্যাম্প করার পরে অংশগ্রহণকারী শিশুরা যাতে বাসায় গিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারে সেজন্য এখন থেকে তাদের হাতে রকেট তৈরির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে দেয়া হবে। তবে যন্ত্রপাতির মিনিমাম যে মূল্য সেটা দিয়ে তাদের নিতে হবে। এখন থেকে তাদের তিন মাসের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দেয়া হবে। সেটা তারা বাসায় প্র্যাকটিস করবে। তিন মাস পরে আবার তাদের নিয়ে ক্যাম্প করা হবে। এটা সিটি বা বিভাগভিত্তিক হতে পারে। যে ভাল পারফর্ম করবে তাদের পুরস্কার দেয়া হবে।

বিবার্তা : শিশু-কিশোরদের জন্য রকেট টেকনোলজি নিয়ে নাসায় আয়োজিত প্রোগ্রামগুলো বাংলাদেশে চালু করার কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কী?

আরিফুল হাসান অপু : আপনি জেনে খুশি হবেন যে, ইতোমধ্যেই ইউ এস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টারের সাথে আমাদের প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগিরই এ বিষয়ে অফিসিয়াল চুক্তি হবে। এই চুক্তি অনুসারে প্রতি বছর বাচ্চাদের মধ্য থেকে ১০জন এবং সিনিয়রদের মধ্য থেকে ১০জনকে নাসায় ইউ এস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টারে পাঠানো যাবে।

বিবার্তা : ইনোভেশন ফোরামের পক্ষ থেকে রকেট টেকনোলজি নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?

আরিফুল হাসান অপু : আমাদের ইনোভেশন ফোরামের পক্ষ থেকে আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশে রকেট টেকনোলজি অ্যান্ড স্যাটেলাইট টেকনোলাজির উপরে ছোট আকারের একটা গবেষণাগার করতে চাই। যেটির কাজ ইতোমধ্যেই আমরা শুরু করে দিয়েছি। এরপরে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারের সহযোগিতায় আমরা দেশে একটি স্পেস সিটি বানাতে চাই। যেখানে শিশু-কিশোর-তরুণরা বসে গবেষণা করতে পারবে, স্পেস বা মহাকাশ নিয়ে জানার এবং কাজের মাধ্যমে নিজে অভিজ্ঞতা করার সুযোগ পাবে।